এডভোকেট বরকত উল্লাহ খান:
সব অপরাধই কোনো না কোনো পরিমাপে শাস্তিযোগ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দান হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ যখন অপরাধে লিপ্ত হয় তখন তা নিয়ে চিন্তার শেষ থাকে না। কিশোর অপরাধ বলতে সাধারণত ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর কর্তৃক সংঘটিত অপরাধকে বোঝানো হয়। একজন কিশোর বা কিশোরীর সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডকেই কিশোর অপরাধ বলে।
১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর কর্তৃক সংঘটিত অপরাধকে বলা হয় “জুভেনাইল ডেলিকোয়েন্সি”। শিশুদের অবহেলা, দারিদ্র্য, অসচেতনতা, অপরাধীদের সংস্পর্শ, পারিবারিক কলহ, অভিভাবকের অনুপস্থিতি, বিচ্ছিন্নতা, ভুল দিকনির্দেশনা, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের অপরাধ বিশেষ করে হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদক, জুয়া, পর্নোগ্রাফি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি অপরাধ বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। পুলিশের তথ্যমতে, ‘শিশু-অপরাধ’ নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরেই হত্যা, ধর্ষণ ও মাদকের অপরাধ সমাজে বিস্তারলাভ করছে। বিশেষ করে ঢাকা শহর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো এখন কিশোর অপরাধের ভয়াল গ্রাসে জর্জরিত। মাদকাসক্ত কিশোর গ্যাং মেম্বারদের হাতে খুন ও ছিনতাইয়ের ঘটনা এবং প্রেমের দ্বন্দ্বে খুনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গ্যাং সদস্যরা অধিকাংশ সময় মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে মাদক চোরাচালানের সাথে যুক্ত থাকে। কেউ কেউ আবার শক্তি-প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অবৈধ অস্ত্রও ব্যবহার করে থাকে। তারা তাদের ক্ষমতা দেখানোর জন্য অল্পতেই খুন করে ফেলে।
কিশোরদের মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে খুন-খারাপি বেড়ে চলছে। শিক্ষার মান অবনতি, অভিভাবক পরিবারের বাবা-মার উচ্চমাত্রার ব্যস্ততা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, পারিবারিক অশান্তি ইত্যাদি কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এর প্রতিকার হিসেবে দরকার আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা। কিশোর অপরাধের কারণ বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন: প্রযুক্তিগত, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের অশ্লীল কন্টেন্ট শিশু-কিশোরদের বিপথগামী করছে।
বিশেষ করে ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটকসহ বিভিন্ন অ্যাপস ওয়েবসাইটে অশ্লীল কনটেন্ট দেখে তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিশোর অপরাধকে রোধ করার জন্য সুদৃঢ় পরিবার গঠন প্রয়োজন। বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের প্রতি যত্নবান হতে হবে। সন্তানদের মানসিক বিকাশের জন্য সহিষ্ণু ও ইতিবাচক আচরণ করতে হবে। তাদের সময় দিতে হবে। সঠিক পথ দেখাতে হবে। সামাজিকভাবে বললে, পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজকর্মী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি আন্তরিকভাবে কাজ করে তবে কিশোর অপরাধ দমন সম্ভব। প্রযুক্তির অপব্যবহার কমাতে কিশোরদের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ইন্টারনেট কনটেন্ট, ভিডিও গেমস এবং টিকটক-রিলস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য জাতীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কিশোর অপরাধকে শুধুমাত্র আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বরং পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় উদ্যোগের সমন্বয় প্রয়োজন। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আইন অনুযায়ী, অপরাধ করলে কিশোরদের সাধারণ আদালতে বিচার হয় না। তাদের জন্য আলাদা শিশু আদালত রয়েছে। শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, শিশু-কিশোর অপরাধ করলে তাদের সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।
১৯৯০ সালের জাতিসংঘের শিশু অধিকার কনভেনশনের আলোকে বাংলাদেশ শিশু আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোর অপরাধীদেরকে সংশোধন, শিক্ষা এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শাস্তি দিয়ে নয়, বরং শিক্ষা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব। — কিশোর অপরাধ আইন ও প্রতিকার (অংশ-২) বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ধারা ৮২ অনুযায়ী ৯ বছরের কম বয়সের কোনো শিশুর অপরাধসমূহকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। আর ধারা ৮৩ অনুযায়ী ১২ বছরের কম বয়সী শিশুর অপরাধকে তখনই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে, যখন শিশুটি যথেষ্ট পরিমাণে ভাল-মন্দ বোঝার ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।
শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৪ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তিকেই শিশু ধরা হবে। অর্থাৎ, দণ্ডবিধির শিশু সংক্রান্ত বিধানের সাথে শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৪ এর মধ্যে বয়স নিয়ে অসঙ্গতি রয়েছে। দণ্ডবিধিতে যেখানে ১২ বছর এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে, সেখানে শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে কেউ অপরাধ করলে তাকে শিশু বা কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। বিচারকার্য এবং শাস্তির ক্ষেত্রে কিশোর অপরাধীদের জন্য অপরাধের ধরন ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীদের জন্য সংবিধানসম্মত ব্যবস্থারও দেখা মেলে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইন সমানভাবে সমান সুরক্ষা পাবে। এছাড়া ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্ম, গোষ্ঠী, লিঙ্গ, জাতীয়তা ইত্যাদির কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।
সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, শিশুদের জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা যাবে। এই আলোকে কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য বিচার চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক, বিশেষভাবে পুলিশ কর্মকর্তা, প্রবেশন কর্মকর্তা এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। শিশুদের চালাচালি, আইনি সেবা, পুলিশ ও অনান্য সংস্থার মাধ্যমে তাদের স্কুলে পড়াশোনা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব ইউনিসেফ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও পালন করে আসছে। বিচার কার্যক্রমের কোনো এক পর্যায়ে অনুমোদিত বিচার কার্যক্রমের পরিবেশে বিশেষ পারিবারিক আদালত, সামাজিককর্মী, মনোবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ এবং প্রবেশন কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে শিশুদের পুনর্বাসন বিষয়ক পরামর্শ (কাউন্সেলিং) গ্রহণ করার বিধান রয়েছে।