২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

আগের জৌলুস নেই বেনারসি পল্লীতে

আপডেট: মে ৫, ২০২১

বিজয় ডেস্ক ॥ বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনি বেনারসিপল্লিতে নেই আগের মতো সরগম। জীবন বাঁচাতে কোনোভাবে পেশাটাকে ধরে রেখেছে এখানকার কারিগররা।

মঙ্গলবার (৪ মে) বেনারসি পল্লি নামে খ্যাত ঘোলাগাড়ী কলোনিতে গিয়ে দেখা মেলে শাড়ি তৈরির কর্মযজ্ঞ।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা শহর। সেখান থেকে ৪-৫ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে দেখা মিলবে এই কলোনির। বাইরের মানুষের কাছে ঘোলাগাড়ী কলোনি ‘বেনারসি পল্লি’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। নারীরাও এ পেশায় নিজেদের যুক্ত করতে থাকেন। সাংসারিক কাজের ফাঁকে-ফাঁকে এ কাজ করেন তারা।

 

বেনারসি পল্লিতে বেনারসি, বুটিক, জামদানি, টাইটাকি, কাতান, কাতান বুটিক, পাটি নামের বাহারি ডিজাইনের শাড়ি বানানো হয়। এসব বাহারি শাড়িতে ফুটে ওঠে প্রতিটি বাঙালি ললনার প্রকৃত রূপ-মাধুরি। আর সেই শাড়ি যদি মানসম্পন্ন ও পছন্দের হয় তবে তো কথাই নেই।

 

এসব পোশাক তৈরিতে মাটির ওপর গড়ে তোলা হয় কারখানাগুলো। মাটি কেটে নির্দিষ্ট স্থানে চার কোণাকৃতির গর্ত তৈরি করা হয় প্রত্যেক কারখানার জন্য। গর্তে আসন গাড়েন কারিগরা। সেখানে বসেই মেশিন চালান তারা। বাহারি ডিজাইনের ক্যাটালগ লাগানো হয় প্রত্যেক তাঁত মেশিনে। সামনে জালের মত বিছানো থাকে রঙ-বেরঙ-এর সুতা। কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় এই সুতা একসময় হয়ে ওঠে একেকটি আকর্ষণীয় শাড়ি।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, কারিগররা তাদের হাত-পায়ের তালে তালে চালিয়ে যাচ্ছে তাঁত। সচল মেশিনে সুতাভর্তি কাঠ নিয়ে একহাত এপাশ-ওপাশে চালনা করছিলেন তাঁতি। সমানতালে চালাচ্ছিলেন পা। মেশিন সচল রাখতে গিয়ে হাত-পা যেন সমান তালে চলছে তাদের। যতই ক্লান্তি আসুক না কেন মেশিন বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ নেই দম ফেলারও। বেনারসি পল্লিতে সারাক্ষণ কেবল ‘খটাশ-খটাশ’ শব্দে ঘূর্ণায়মান মেশিনে সূতা গোছানোর পাশাপাশি ড্রাম মেশিনের সাহায্যে সুতা প্রসেসিংসহ শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিক।

 

বেনারসি পল্লিতে এ আয়োজন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে। দরজায় কাড়া নাড়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে ঘনিয়ে আসছে ঈদুল ফিতর। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেনারসি তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা।

 

এতো তোড়জোড়ের পরেও কারিগরদের রয়েছে বড় একটি সমস্যা। তাঁত মেশিনের সাহায্যে এখানে উন্নতমানের শাড়ি তৈরি করা হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত সাপোর্ট না থাকায় ফিনিশিংয়ের কাজ করতে হয় ঢাকায় গিয়ে। এজন্য যেতে হয় ঢাকার মিরপুর বেনারসি পল্লিতে। ফিনিশিংয়ের কাজ শেষে তারা নিজ গাঁয়ে ফিরে আসেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করা বেনারসিসহ হরেক রকমের শাড়িগুলো বাজারজাত করেন।

 

এ ক্ষেত্রেও তারা ঢাকার ওপর নির্ভরশীল। কেননা এ শাড়িগুলো তারা শুধুমাত্র ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছেই বিক্রি করেন। কারখানার মালিক আজিম মিয়া, সালাউদ্দিন, নাসিম জানান, শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তারাসহ হাতে গোনা কয়েকজন প্রথম শাড়ির বুননের কাজ শুরু করেন। সেসময় প্রতিটি মেশিন স্থাপনে ব্যয় হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ঢাকার মিরপুর থেকে শাড়ি তৈরির সুতা, জরি, কেলা, তানি, রংসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেন। এভাবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারখানা তৈরিতে তিনটি ধাপের প্রয়োজন হয়।

 

তারা জানান, তাদের তৈরি শাড়িগুলো ঢাকার মিরপুর-১০, ১১, ১২ এর ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। মিরপুরের ব্যবসায়ীরা ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তৈরি করা বেনারসি শাড়ির প্রধান ক্রেতা। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় এসব শাড়ি বিক্রি করা হয়ে থাকে। তবে তা সংখ্যায় অনেক কম। সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে ব্যবসায় তেমন একটা সুবিধা করতে পারছেন না বলেও মন্তব্য করেন তারা।

 

কারখানা মালিক খোরশের আলম, ওয়াহেদ রানা জানান, আগের মতো বেনারসি পল্লি খ্যাত এ এলাকায় শাড়ি তৈরির কাজ হয় না। যুগের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। ১০ থেকে ১২ বছর আগেও এ উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনি, বড়পুকুর ও পাঁচআড়ঙ্গ এলাকায় একসময় ব্যপক পরিসরে বেনারসি তৈরি করতো কারিগররা। শুধুমাত্র ঘোলাগাড়ী কলোনি এলাকায় ৪০ থেকে ৫০টির মতো তাঁত মেশিন স্থাপন হয়েছিলো।

 

কিন্তু বর্তমানে সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫-২৫টিতে। বেনারসি শাড়ি তৈরি করে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে তেমন লাভের মুখ দেখতে পান না কারখানা মালিকরা। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।

 

বগুড়ার তৈরি বেনারসি পাইকারি বাজারে ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। পাকিস্তানি ও দেশীয় সুতার ব্যবহার হয়ে থাকে এ শাড়িগুলোতে। ঢাকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বেনারসি শাড়িগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে কারিগররা সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।

200 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন