আপডেট: জুলাই ১৯, ২০২৫
অনলাইনি নিউজঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বা কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বাতিল করে সরকার যেটি করেছে, সেটি কেবল একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এটা এক ধরনের শিক্ষানীতিগত বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সামিল।
১৭ জুলাই ২০২৫, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি পরিপত্র জারি করে জানানো হয়, চলতি বছরের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় কেবলমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই অংশ নিতে পারবে। কিন্ডারগার্টেন বা এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নয়। অর্থাৎ দেশের শহরাঞ্চলের লাখো শিক্ষার্থী এই পরীক্ষার বাইরে থাকছে শুধুমাত্র তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরন ভিন্ন বলে।
১৫ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এই পরিপত্র জারির পর থেকেই দেশের লাখ লাখ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষক-উদ্যোক্তাদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বইছে এবং সংগঠিতভাবে আন্দোলনের প্রস্তুতির কথাও শোনা যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে—শিক্ষার মেধা যাচাইয়ের এমন একটি জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় কেন কিছু শিশুকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে? কেন একটি শিশুর ভবিষ্যৎ প্রাথমিক পর্যায়েই নীতিনির্ধারকদের এই শ্রেণিবিভাজনের বলি হবে?
বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলত অভিভাবকদের চাহিদা, সরকারি ব্যবস্থার ঘাটতি এবং কিছুটা মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার অভাবের কারণে বিকশিত হয়েছে। শহরাঞ্চলে অনেক পরিবারই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তান পাঠাতে চান না নানা কারণে—শিক্ষকের স্বল্পতা, অবকাঠামোর দুরবস্থা তো আছেই, পাঠদানের মান নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। সেই জায়গা থেকে নানা রকম কেজি স্কুল গড়ে উঠেছে। অনেকেই নির্দিষ্ট কোনো সরকারি স্বীকৃতির আওতায় না থাকলেও, বাস্তবে তারা প্রাথমিক শিক্ষার অনেক বড় একটি অংশ জোগান দিচ্ছে।
২০২২ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যে দেখা যায়, দেশে আনুমানিক ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এটি বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী এবং দশ লক্ষাধিক শিক্ষক সরাসরি কিন্ডারগার্টেন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত।
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করে ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেছেন, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে কোনো ধরনের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে তা বৈষম্য ছাড়া কিছু নয়। একে তিনি দেশের শিক্ষা কাঠামোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেও অভিহিত করেন। তার ভাষায় এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে নীতিনির্ধারকরা যদি এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে তা শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। একইসঙ্গে বাংলাদেশ বেসরকারি স্কুল বোর্ড ও বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দও যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান জানিয়েছেন এবং প্রয়োজনে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।
মূলত, ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে বৃত্তি পদ্ধতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে ২০২২ সালে আবারও বৃত্তি পরীক্ষা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মেধা বৃত্তি’ এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ‘উপবৃত্তি’ চালু থাকে। চলতি বছর নতুন করে বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২১-২৪ ডিসেম্বর তারিখে। চারটি বিষয়ে—বাংলা, ইংরেজি, প্রাথমিক গণিত এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ও প্রাথমিক বিজ্ঞান (যেখানে শেষ দুটি বিষয় একত্রে ৫০ শতাংশ করে এক পত্রে)—এই পরীক্ষা হবে বলে জানা গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যখন কিন্ডারগার্টেনের লাখ লাখ শিক্ষার্থী বছরজুড়ে কঠোর পড়াশোনা ও প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আশায় এগিয়ে এসেছে, তখন হঠাৎ করে তাদের বাদ দেওয়ার এমন সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত? বিশেষ করে যখন কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কয়েক মাস আগেই সচিবালয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সচিবের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয় এবং তাদের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণের আশ্বাসও দেওয়া হয়—তখন সিদ্ধান্তে এই পরিবর্তন শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং প্রতারণার শামিল বলেই মনে করছেন অনেকেই।
যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন এখনো নিবন্ধনবিহীন, ফলে সরকার তাদের শিক্ষাগত মান নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না এবং এজন্যই তাদের বৃত্তি পরীক্ষার বাইরে রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যে কিন্ডারগার্টেনগুলো সরকারের সব শর্ত পূরণ করে বৈধভাবে নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয়েছে, সেগুলোকেও কেন এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে? সরকারি বৃত্তির অর্থ তো শিক্ষার্থীর জন্য, প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। সুতরাং যেখানে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার আলোয় নিজেকে প্রস্তুত করেছে, সেখানে তার প্রতিষ্ঠানের আইনি মর্যাদা দিয়ে তার অধিকার বাতিল করে দেওয়াটা অমানবিক বলেই বিবেচিত হবে।
এখানে আরও একটি মৌলিক বিষয় হলো—‘সবার জন্য শিক্ষা’—এই রাষ্ট্রীয় নীতি ও সংবিধানগত অঙ্গীকারের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত সরাসরি সাংঘর্ষিক। শিক্ষা শিশুদের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার থেকে কোনো শিশুকে বঞ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই বহিঃপ্রকাশ। বাস্তবতা হলো, দেশের শিশু শিক্ষার্থীদের অর্ধেকের বেশি কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত। এমন বাস্তবতায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো মূলত সরকারের পরোক্ষ সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবেই কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো না থাকলে কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শুরু করা কঠিন হয়ে যেত। একইসঙ্গে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের এক বড় উৎস। এসব চিন্তা করলে সহজেই বোঝা যায়, কিন্ডারগার্টেন শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোও বটে।
বিভিন্ন সময়ে বলা হয় সরকার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ করতে চায় না, অথচ বৃত্তি পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করতে যাচ্ছে, তখন সাধারণ শিক্ষার্থী-অভিভাবকের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে। এরকম পরিস্থিতিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সিদ্ধান্তের সমন্বয়হীনতা। সচিব ও উপদেষ্টা যখন কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আশ্বাস দেন এবং দেড় মাস পরেই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন সেটিকে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বৈততা বলেই মনে হয়। এটি সরকার ও সাধারণ মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এমনকি যেসব কিন্ডারগার্টেন ইতোমধ্যেই নিবন্ধনপ্রাপ্ত, তাদের ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম না রাখায় বিষয়টি আরও বিতর্কিত হয়েছে। একটি নিবন্ধিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা ইসমাত আরা প্রশ্ন তুলেছেন—নন-এমপিও ভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারে, তাহলে নিবন্ধনপ্রাপ্ত কিন্ডারগার্টেন কেন বঞ্চিত হবে? সরকার যদি কিন্ডারগার্টেনকে শিক্ষাব্যবস্থার স্বীকৃত অংশ মনে না করত, তবে কেনইবা ২০২৩ সালে নতুন করে পরিপত্র জারি করে শত শত স্কুলকে পাঠদানের অনুমতি দিল?
অথচ বর্তমান সরকারই ‘বৈষম্যবিরোধী সরকার’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে—‘শিক্ষা হবে সবার জন্য, সমান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’। তাহলে এই বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত সেই চেতনাকেই ধূলিসাৎ করছে না তো?
সকল শিশুই সমান সম্ভাবনার অধিকারী। রাষ্ট্রের কাজ সেই সম্ভাবনার সিঁড়ি তৈরি করা, তা ভেঙে দেওয়া নয়। সরকারের উচিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের চলতি বছরই প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। পাশাপাশি আগামী এক বছরের মধ্যে যেসব স্কুল নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বৈধ-অবৈধ, যোগ্য-অযোগ্য—সব শিক্ষার্থীকে এক কাতারে ফেলে বঞ্চিত করাটা একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। প্রাথমিক শিক্ষা হলো জীবনের ভিত্তি। সেই ভিত্তি যদি বৈষম্য দিয়ে গঠিত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনো ইতিবাচক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।তথ্যসূত্রঃবাংলানিউজটোয়েন্টিফোর