২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

বরিশালে বিএনপির ৫ আসন জোটকে দিলে মাঠে থাকবেনা তৃণমূল

আপডেট: নভেম্বর ১১, ২০২৫

আকতার ফারুক শাহিন, বিশেষ প্রতিবেদক, বরিশালঃ বরিশালের পাঁচ আসনে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। শোনা যাচ্ছে, জোট বা সমমনা দলকে দেওয়া হবে এসব আসন। স্থানীয় নেতা ও সাধারণ ভোটাররা বলছেন, সেটি হলে ‘ধানের শীষের নিশ্চিত’ এসব আসনে পরাজয়ের ঝুঁকিতে পড়বে দলটি। কারণ, জোট বা সমমনা দলের প্রার্থী হিসাবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে-তাদের প্রায় চেনেই না এলাকার মানুষ। জামায়াতের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীতে ভোটের মাঠে এরা কতটা দাঁড়াতে পারবেন তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

পিরোজপুর-১ (জিয়ানগর-সদর-নাজিরপুর) : এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মরহুম দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী। এখানে বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন জেলা আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম খান, সাবেক আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আলমগীর হোসেন ও দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এলিজা জামান। আলোচনায় রয়েছে, আসনটি জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দারকে দিতে পারে বিএনপি।

জিয়ানগরের বাসিন্দা আল আমিন খান বলেন, ‘হতে পারে যে উনি (মোস্তফা) জাতীয় নেতা। কিন্তু এলাকার কতজন ওনাকে চেনে?’ নাজিরপুরের বাসিন্দা গোলাম মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের এখানে তো জাতীয় পার্টির (জাফর) কোনো কর্মকাণ্ডই নেই। কারা এখানে উনার কর্মী-সমর্থক- তাইতো চিনি না।’ পিরোজপুর পৌর এলাকার আলী নেওয়াজ বলেন, ‘এমন হতে পারে যে, উনি বিএনপির আশায় ভোট করতে আসবেন। কিন্তু দলীয় প্রার্থী না থাকলে স্থানীয় বিএনপি তার পক্ষে কতটুকু থাকবে, তাই নিয়ে সন্দেহ আছে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে জিতে গেছে জামায়াত।’

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব সাইদুল ইসলাম কিসমত বলেন, ‘আমাদের নিশ্চিত বিজয়ের আসন কেন অন্যদের ছাড়া হবে? ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় অবশ্যই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন।’ জোটকে দেওয়া হলে জেতার সম্ভাবনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পুরো বিষয়টাই তখন অনিশ্চিত হয়ে যাবে।’

পটুয়াখালী-২ (বাউফল) : বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন দলের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক মুনির হোসেন, সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার ও ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার। জামায়াতের প্রার্থী দলের প্রভাবশালী নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। আসনটি এনসিপিকে ছেড়ে দেবে বিএনপি-এমন আলোচনা রয়েছে এলাকায়। এনসিপির প্রার্থী হিসাবে শোনা যাচ্ছে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. মুজাহিদুল ইসলাম শাহিনের নাম। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শাহিনের বাবা মাওলানা ইসাহাক মিয়া বাউফল উপজেলা জামায়াতের আমির। শাহিন ২০১১ সালে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক। ৫ আগস্টের আগে এলাকায় তেমন পরিচিতি না থাকা শাহিন বর্তমানে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল। বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার প্রতিষ্ঠিত কলেজের গর্ভনিং বডির সভাপতি। ড. মাসুদের সঙ্গেও রয়েছে তার ঘনিষ্ঠতা।

পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, ‘নামে এনসিপি হলেও অ্যাড. শাহিন তো জামায়াতেরই প্রতিরূপ। আসনটিতে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। আমরা চাই, এখানে ধানের শীষের কাউকে দেওয়া হোক।’

পটুয়াখালী-৩ (গলাচিপা-দশমিনা) : গুঞ্জন রয়েছে গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নূরকে ছাড়া হবে আসনটি। এখানে বিএনপির একমাত্র মনোনয়ন প্রার্থী দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুন। জামায়াতের প্রার্থী অধ্যাপক শাহ আলম-যিনি ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। পালন করেন বিএনপি প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনি এজেন্টের দায়িত্ব।

উপজেলা বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, ‘এখানে গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক আমাদের। ৫ আগস্টের পর কয়েক দফা সংঘর্ষ মামলা-পালটা মামলাও হয়েছে। নূরকে আসন ছাড়া হলে স্বভাবতই তার পক্ষে কাজ করবে না তৃণমূল। ওদিকে জামায়াত প্রার্থীর সঙ্গে বহু আগে থেকেই সু-সম্পর্ক দলের ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের। টানা ১৭ বছর ধরে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে মামলার আসামি হওয়া থেকে শুরু করে আদালতের বারান্দায় ছুটেছেন শাহ আলম। গণঅধিকারকে দেওয়া হলে প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ভেতরে সবাই সমর্থন দেবে তাকে। ফলে জেতা মুশকিল হবে নূরের। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মজিবুর রহমান বলেন, ‘সবকিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। কেবল এটুকু বলতে পারি যে, ধানের শীষের বাইরে প্রার্থী হলে জয় নিশ্চিত করা কঠিন হবে।’

ঝালকাঠী-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) : বিএনপির কাছ থেকে আসনটি পাওয়ার আশায় মাঠে আছেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। এখানে বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন দলের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল, সাবেক ছাত্রদল নেতা গোলাম আজম সৈকত ও নিউইয়র্ক বিএনপির নেতা সেলিম রেজা। দলের কাউকে প্রার্থী না করে এখানে স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ফয়জুল হককে অঘোষিত সমর্থন দিয়েছে জামায়াত। বর্তমানে দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও মালয়েশিয়া বিএনপির একসময়কার নেতা ফয়জুল হক ঝালকাঠীর সবার কাছে শ্রদ্ধেয় মরহুম কায়েদ সাহেব হুজুরের নাতি। এলাকায় রয়েছে তার ভালো অবস্থান।

২০১৮-এর নির্বাচনে পিরোজপুর-২ আসনে ইরানকে মনোনয়ন দিয়েছিল বিএনপি। ধানের শীষ নিয়েও প্রায় দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। ঝালকাঠী-২ আসনের সাধারণ ভোটাররা তাকে চেনে না বললেই চলে। এখানে লেবার পার্টির তেমন সাংগঠনিক ভিত্তি বা কর্মী-সমর্থক নেই। মনোনয়ন পেলেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাকে কতটুকু সহায়তা করবে, তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনে ঝালকাঠী-১ আসনে কখনোই হারেনি বিএনপি। আসনটি অন্য কোনো দলকে দেওয়া হলে তা হবে দুঃখজনক। তাছাড়া অচেনা-অজানা কেউ চাইলেই এখান থেকে এমপি হতে পারবেন-সেটা ভাবাও ভুল। তারপরও দলের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।’

বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) : স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান ছাড়া আরও দুজন বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন এ আসনে। তারা হলেন, ভাইস চেয়ারম্যান আইনজীবী নেতা অ্যাড. জয়নাল আবেদিন এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুলাদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুস সাত্তার খান। এখানে প্রার্থী হতে চাইছেন এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তার বাড়ি বাবুগঞ্জে। ৫ আগস্টের আগে তাকে তেমন চিনত না এলাকার মানুষ। বর্তমানে অবশ্য নিয়মিত আসছেন এলাকায়। তারপরও ধানের শীষহীন নির্বাচনে এবি পার্টির ঈগল কতটুকু কী করতে পারবে সেটাই প্রশ্ন। দলীয় কাউকে দেওয়া না হলে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে বিএনপিতে-তেমন গুঞ্জনও রয়েছে। এর উপর রয়েছেন জামায়াতের শক্ত প্রার্থী বরিশাল মহানগর জামায়াতের আমির জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর।

বাবুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, ‘নতুন একটা প্রতীক সবার কাছে পরিচিত করতেই তো বছর পেরিয়ে যাবে। আসন নিশ্চিত করতে হলে এখানে ধানের শীষের বিকল্প নেই।’

56 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন